ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন জানিয়ে অনলাইনে তহবিল সংগ্রহের ওয়েবসাইট গোফান্ডমিতে পেইজ চালু করেছিলেন এক নারী। অনেকেই তাকে সহায়তার জন্য এগিয়ে আসেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় ৭০০ জন দাতা অনলাইনে এই নারীকে দান করেন ৪৫ হাজার ইউরো। যা বাংলাদেশি প্রায় ৪৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকার বেশি।
পরে জানা যায় নিকোল এলকাব্বাস নামের এই নারী সবাইকে বোকা বানিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। আসলে তিনি ক্যানসার আক্রান্ত নন। শুধু তাই নয়, প্রতারণার মাধ্যমে সংগৃহীত এই টাকা তিনি বিদেশ ঘুরে, জুয়া খেলে উড়িয়ে দিয়েছেন, করেছেন কেনাকাটাও।
এমনকি তিনি টটেনহ্যাম হটস্পার একটি ম্যাচ দেখতে বিলাসবহুল বক্সের টিকেট কেটেছিলেন ৩ হাজার ৫৯২ ইউরো (৩ লাখ ৫৪ হাজার ৮৭৬ টাকা) দিয়ে।
৪৪ বছর বয়সী নিকোল ইংল্যান্ডের কেন্টের ব্রডস্টেয়ার্সের বাসিন্দা। গোফান্ডমিতে ক্যানসারে আক্রান্তের মিথ্যা দাবি করে ৪৫ হাজার ৩৫০ ইউরো তুলেছিলেন তিনি। স্পেনের একটি হাসপাতালে ডিম্বাশয়ের ক্যানসারের চিকিত্সার জন্য অর্থ-সহায়তা চেয়ে পেইজটি চালু করেছিলেন।
তহবিল সংগ্রহের কয়েকদিন আগে হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাকে ক্যানসার মুক্ত ঘোষণা করেছেন বলে জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, হাসপাতালের পাওনা পরিশোধের সক্ষমতা তার নেই, সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।
ক্যানসার আক্রান্তের ভান করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া এই নারীর বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। প্রায় ৭০০ জন ভূক্তভোগীর কাছ থেকে ৪০ লাখের বেশি টাকা হাতিয়ে নেন। তদন্তে এই নারীর ক্যানসার আক্রান্তের দাবিটি মিথ্যা এবং প্রতারণার মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে। কোনও আর্থিক সম্পদ অথবা ভুক্তভোগীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা না থাকায় আদালত তাকে আগামী ২৮ দিনের মধ্যে মাত্র ৫ ইউরো শোধ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
তদন্তকারীরা নিকোলের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার পর দেখেছেন, কেন্টের এই নারী বিভিন্ন সময়ে প্রতারণার মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে ৩ লাখ ৬০ হাজার ইউরো (বাংলাদেশি সাড়ে ৩ কোটি টাকার বেশি) হাতিয়েছেন। আর এই অর্থের বেশিরভাগই তিনি উড়িয়েছেন বিদেশ ঘুরে, জুয়া খেলে, কেনাকাটা করে।
তদন্তকারীরা কেন্টারবুরি ক্রাউন আদালতকে বলেছেন, নিকোল শুধুমাত্র ২০১৮ সালেই জুয়া খেলে উড়িয়েছেন ৬০ হাজার ইউরোর (বাংলাদেশি ৫৯ লাখ ২৭ হাজার টাকা) বেশি। আর নিজের এই অভ্যাসকে ‘অতিরিক্ত, অনিয়মিত এবং চরম’ বলে বর্ণনা করেছেন তিনি।
২০২০ সালের নভেম্বরে আদালতের শুনানিতে নিজের দোষ স্বীকার করেননি সাবেক এই হ্যারোডস ফ্যাশন পরামর্শক। সেই সময় নিকোল দাবি করেছিলেন, তিনি সত্যিই বিশ্বাস করেছিলেন যে— তার ক্যান্সার হয়েছে। গত বছর এলকাব্বাসকে দুই বছর ৯ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বিচারক মার্ক উইকিস বলেছেন, জুয়া খেলার অভ্যাসের কারণে তিনি লোকজনের সাথে ইচ্ছেকৃত প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করতেন।
এমনকি কে কত অর্থ দিয়েছেন তার হালনাগাদ হিসেব-নিকেশও প্রকাশ করতেন এই নারী। নিকোলকে উদ্দেশ করে বিচারক বলেন, আপনি মিথ্যার জালে যাদের ফাঁদে ফেলেছেন, তাদের আস্থা ধরে রাখার জন্য চিকিত্সার বিষয়ে বিশদ বিবরণ এবং মাঝে মাঝে গ্রাফিক অ্যাকাউন্ট তৈরি করতেন।
তিনি বড় ধরনের একটি অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপির ছয়টি চক্র এবং একটি দুর্লভ ওষুধের মিথ্যা গল্প সাজিয়েছিলেন। কিন্তু তার এই অপকর্ম ধরা পড়ে তিনি যে চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিয়েছেন, সেই চিকিৎসকের নজরে গোফান্ডমির পেইজটি নজরে আসার পর।
‘আমাদের সহায়তা নিকোলের দরকার- চিকিৎসা’ শিরোনামে গোফান্ডমিতে চালু করা পেইজে কয়েক মাস আগে পিত্তথলির অস্ত্রোপচারের পর তোলা একটি ছবি জুড়ে দেওয়া হয়। এতে তাকে ‘সুন্দরী কন্যা’ এবং ‘তার প্রিয় ১১ বছর বয়সী ছেলের স্নেহময়ী মা’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়। যা মানুষের হৃদয়ে নাড়া দেয়।
শেষ পর্যন্ত গোফান্ডমির পেইজটি নজরে আসে নিকোলের সাবেক বন্ধু লন্ডনের স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ জর্জ সাভেলাসের। আদালতকে তিনি বলেন, তিনি নিকোলের শরীরে ক্যানসারের উপসর্গ খুঁজে পাননি। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে এক অস্ত্রোপচারের পর থেকে তার উভয় ডিম্বাশয় স্বাভাবিক রয়েছে।
আর গোফান্ডমিতে যে ছবিটি জুড়ে দিয়ে বলা হয়েছে, এটি স্পেনে তোলা; সেটি আসলে ইংল্যান্ডের মার্গেট শহরের। বার্সেলোনার তেকনন ক্লিনিকে ছবিটি তুলেছিলেন বলে দাবি করা হলেও লন্ডন পুলিশ স্পেনে যোগাযোগের পর নিশ্চিত হয়, ছবিটি ওই ক্লিনিকে তোলা হয়নি।
ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা নিকোলের সম্পর্কে কখনও কিছু শোনেনি। এমনকি ওই ক্লিনিকের চিকিৎসকদের কাছে তার চিকিৎসা নেওয়ার কোনও নথিপত্রও নেই।
সূত্র: ডেইলি মেইল।